ভাইরাল আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু কাহিনী| Malati Murmu Story



🌿 চক, মাটি আর স্বপ্ন: আদিবাসী নারী মালতী মুর্মুর জীবন, উদ্যোগ/ প্রচেষ্টা, প্রভাব।


✨ ভূমিকা

বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে; ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স.কম (টুইটার), ইউটিউব একটি নাম ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে আদিবাসী নারী মালতী মুর্মুপশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার অযোধ্যা পাহাড়ের জিলিংসেরেং গ্ৰামের এই আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু। তার দারিদ্রতার মধ্যে কাজের মাধ্যমে লাখ লাখ মানুষের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছেন। যেখানে এখনও অনেক গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি, সেখানে এক নারী দাঁড়িয়ে রচে ফেলেছেন এক নতুন ইতিহাস। যেখানে ভাইরাল ভিডিও তে দেখা গেছে দুই মাসের শিশুকে কোলে নিয়ে, শিশুদের বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করছেন, বর্তমান সময়ে এই আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু অনুপ্রেরণা হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়া ভাইরাল। 

মালতী মুর্মু — এক সাধারণ একজন আদিবাসী নারী, তার নিজের মাটির ঘরে গড়ে তুলেছেন একটি স্কুল। কোনো সরকারি চাকরি, কোনো অনুদান বা প্রচার ছাড়াই, শুধুমাত্র ভালবাসা আর দায়বদ্ধতা থেকে শুরু হয় তার এই সাহসী যাত্রা। এই গল্প শুধু একজন নারীর নয়, এটি আমাদের শিক্ষানীতির ফাঁক, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং নারীর আত্মবিশ্বাসের প্রতীক হয়ে উঠেছে।আজকে এই ব্লগে আমরা মালতি মুর্মুর জীবন, উদ্যোগ/ প্রচেষ্টা এবং সমাজে তার প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু
চিএ: সোশ্যাল মিডিয়া।



🛖 আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু: জীবন যাত্রার শুরু

মালতী মুর্মু পুরুলিয়ার একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের অধিবাসী। তার ২০১৯ সালে যখন বিয়ে হয়, বিয়ের পর স্বামীর বাড়ি আসেন। অর্থাৎ জিলিংসেরেং-এ গ্ৰামে আসেন (পুরুলিয়া জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল), তখন সেখানে স্কুল থাকলেও, শিশুদের পড়াশোনায় আগ্রহ ছিল কম। অনেক শিশুর পরিবারও পড়াশোনাকে মনোযোগ দিত না। মালতি মুর্মু লক্ষ্য হলো গ্ৰামের শিশুদের শিক্ষার আলো দিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা।

তখন মালতী মুর্মু সিদ্ধান্ত নেন — “চাকরি না থাক, স্কুল তো নিজেই করা যায়!” শুরু হয় নিজের বাড়ির সামনের মাটির ঘর তৈরি করে পড়াতেন হয়তো শুরু ৩-৪ জন শিশুকে নিয়ে হয়েছিল, পরবর্তীতে তার দিনে দিনে শিশুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। আজ সেখানে ৪৫ থেকে ১০০ জন শিশু প্রতিদিন পড়াশোনা করে থাকে।


📚 আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু: উদ্যোগ/ প্রচেষ্টা, ভাষা ও সংস্কৃতির স্কুল

মালতী মুর্মু নিজের প্রচেষ্টায়/ উদ্যোগে মাটির ইস্কুল তৈরি করে বাস্তবায়ন করেছেন। এই মাটির ইস্কুলে সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল তিন ভাষায় শিক্ষা। এই মাটির ইস্কুলে নেই কোন বড় অবকাঠামো বা সরকারি সহায়তা। তিনি নিজেই শিক্ষিকা হিসাবে কাজ করেন তাও আবার দুই বছরের ছোট্ট শিশুটিকে কোলে নিয়ে।

  1. শিশুরা শেখে সাঁওতালি ভাষাতে (ওল চিকি লিপিতে)।
  2. শিশুরা শেখে বাংলা।
  3. এছাড়া শিশুদের ইংরেজিও শেখানো হয়।

এই বহুভাষিক শিক্ষা শুধু শিশুরা সহজে বুঝতে পারে বলেই না, তাদের সংস্কৃতি ও পরিচয়ও বাঁচিয়ে রাখে
এখানে শিশুরা বলে;
দিদি আমাদে ভাষায় পড়ায়, তাই আমরা ভয় পাই না।” এই উদ্যোগ আজ একটি ভাষা সংরক্ষণ ও সংস্কৃতি শিক্ষার আদর্শ মডেল হয়ে উঠেছে।


🏛️ সরকার কোথায়? নীতিগত প্রশ্ন

এখানেই উঠে আসে বড় প্রশ্ন:
👉 কেন এখনও এই স্কুল অনানুষ্ঠানিক?
👉 কেন এই ধরনের উদ্যোগে সরকার সহযোগিতা করছে না?

ভারতের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে আদিবাসী ও গ্রামীণ শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও, মাঠপর্যায়ে তা বাস্তব হয়নি।

  • মালতীর স্কুলে নেই লাইব্রেরি, ডিজিটাল লার্নিং, বা সহায়ক শিক্ষক।
  • নেই কোনও সরকারি অনুদান বা এনজিওর সহায়তা

এমন একটা সময়েও, একজন নারী নিজের খরচে, স্বামী ও গ্রামবাসীর সাহায্যে স্কুল চালাচ্ছেন — এটা আমাদের নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যর্থতা নয় কি?


👩‍🏫 আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু: লড়াই পুরো সমাজের জন্য শিক্ষা

আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু গল্প নারী ক্ষমতায়নের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি প্রমাণ করেছেন — শিক্ষার জন্য শুধু ডিগ্রি নয়, দরকার একটা ইচ্ছা আর দায়িত্ববোধ

  • তিনি যখন পড়ান, আশেপাশের মায়েরা তাদের সন্তানদের পাঠান তাঁর কাছে।
  • তাঁর স্বামী ব্যাংকা মুর্মুও পাশে আছেন, প্রতিদিন ক্লাস চালাতে সাহায্য করেন।
  • সমাজ তাকে এখন “মাস্টারনি দিদি” বলে ডাকে।

আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু বলেন:

“আমি চাই না আমার মত কেউ স্কুল না পেয়ে পিছিয়ে পড়ুক।”

এই কথা আমাদের কানে না তুললে, আর কাদের শুনব?


🌱 কীভাবে এই উদ্যোগ আরও এগোতে পারে?

এই ধরনের গ্রামীণ ও সংস্কৃতিনির্ভর শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে কিছু বাস্তব পদক্ষেপ প্রয়োজন:

প্রয়োজনীয়তা প্রস্তাবনা
📖 শিক্ষাসামগ্রী বই, খাতা, শিক্ষনীয় টুলস
💻 ডিজিটাল সহায়তা কম্পিউটার, প্রজেক্টর, নেট সংযোগ
🧑‍🏫 শিক্ষক প্রশিক্ষণ মালতীর মত নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে নেতৃত্বে আনা
🌐 সরকার ও NGO সংযোগ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, CSR সহযোগিতা

❤️ উপসংহার: 

আদিবাসী নারী মালতী মুর্মু তিনি একজন সাধারণ নারী, দারিদ্রতার মাঝেও সমাজের প্রতি তার অবদান অসাধারণ। ভাইরাল এক কারণেই যথেষ্ট নয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া কোনও শেষ নয় — বরং শুরু। মালতী মুর্মু ভাইরাল হয়েছেন, কারণ তাঁর কাজ ব্যতিক্রমী এবং অনুপ্রেরণাদায়ী। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্ব তার জীবনের গল্পের সাহায্য, আজ লাখো লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা। কিন্তু যদি সমাজ ও সরকার এই প্রচেষ্টাকে বাস্তব সহায়তা ও স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে ভাইরাল হওয়াটাই হয়ে থাকবে শুধুমাত্র একটি খবর।

মালতী আমাদের মনে করিয়ে দেন—

“পড়াশোনার আলো সব জায়গায় পৌঁছতে পারে, যদি কেউ একটা আলো জ্বালায়।”

আজ সেই আলো একজন নারী জ্বালিয়েছেন, একটা মাটির ঘরে। এখন সময়, আমরা সবাই সেই আলোকে ছড়িয়ে দিই গোটা সমাজে। মালতী মুর্মু মতো মানুষেরাই প্রমাণ করে যে একটি মানুষের ছোট প্রচেষ্টা মাধ্যমে সমাজের বড় পরিবর্তন আনতে পারে। তাই আমাদের উচিত আমরা তার এই যাত্রায় তার পাশে থাকবো এবং তার সাফল্য কামনা করব।


✍️ লেখক:

[সঞ্জয় মুর্ম্মু]
ব্লগার | সমাজবিশ্লেষক | শিক্ষানীতি পর্যবেক্ষক



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ